ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল মেশানো
খাদ্যে ভেজাল একটি অনৈতিক ও অমানবিক কাজ। এগুলো মুমিনেরতো নয় বরং মানুষেরই কাজ নয়। ইসলামে এ ধরনের কাজ চরমভাবে নিন্দিত। এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িয়ে আছে।
১. এটি প্রতারণা ও ধোকাবাজি।
২. এটি মূলত অবৈধ পন্থায় অপরের অর্থ গ্রহণ যা আত্মসাতের শামিল।
৩. ভেজালমিশ্রিত খাদ্য বিক্রয়ের সময় মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কসম করতে হয়।
৪. মানুষকে কষ্ট দেওয়া।
৫. মানুষকে শারিরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা।
খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ক্রেতার সাথে প্রতারণা করা। প্রতারণা ইসলামে নিষিদ্ধ।খাদ্যে ভেজাল একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। মানবতাবিরোধী এ অপরাধের বিরুদ্ধে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অর্থ হলো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ। এবং তা ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ।
এ ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন-
‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে গুলিয়ে দিও না এবং তোমরা জেনে-শুনে সত্যকে গোপন করো না।’ (সূরা বাকারা : ৪২)
‘মিথ্যার আশ্রয় নেয় তারাই যারা আল্লাহর আয়াতে বিশ্বাস করে না।’ (সূরা নাহল :১০৫)
‘যারা বিনা অপরাধে মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহজাব : ৫৮)
হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করুন এবং সৎকর্ম সম্পাদন করুন। (মনে রাখবেন) আপনারা যা কিছু করেন, সকল বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত’ (মুমিনূন ২৩/৫১)
‘হে মুমিনগণ তোমাদেরকে আমরা যে পবিত্র রূযী দান করেছি, সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যমীন থেকে হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮)
‘নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত, শুকরের গোশত এবং যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত (বাক্বারাহ ২/১৭৩; মায়েদাহ ৫/৩)
যে ব্যক্তি নরহত্যা বা জনপদে ফাসাদ সৃষ্টি ব্যতিরেকেই কাউকে হত্যা করল, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করল’ (মায়েদাহ ৫/৩২)
‘তোমরা পরস্পরকে হত্যা করো না’ (নিসা ৪/২৯)
“মন্দের প্রতিফল মন্দই হবে’ (শূরা ৪২/৪০)
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না’ (নিসা ৪/২৯)
‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি সর্বদা তোমাদের সাথে আছেন এবং তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন-
যে ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-মলিন চেহারায় দু’হাত আকাশের দিকে তুলে আল্লাহকে ডাকে, হে প্রভু! হে প্রভু! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় ও পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারাম খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে। ফলে কিভাবে তার দো‘আ কবুল হবে? (মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬০ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ হা/২৬৪০ )
‘ঐ দেহ জান্নাতে যাবে না, যা হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে’ (বায়হাক্বী-শু‘আব, মিশকাত হা/২৭৮৭, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১ ‘হালাল উপার্জন’ অনুচ্ছেদ-১; ছহীহাহ হা/২৬০৯)
‘ক্ষতিগ্রস্ত হয়োনা এবং কারু ক্ষতি করো না’। (আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০; ছহীহাহ হা/২৫০)
‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয়, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়। ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামী’। (সলিম, মিশকাত হা/৩৫২০; ছহীহ ইবনু হিববান, ছহীহাহ হা/১০৫৮)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন একটি খাদ্যস্ত্তপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলে তাঁর হাত ভিজে গেল। তিনি বিক্রেতাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তাহ’লে তুমি কেন ভিজা অংশটি উপরে রাখলে না? মনে রেখ, যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়’। (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮৬০ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১ অনুচ্ছেদ-৫)
একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বললেন,‘তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? তারা বলল, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি যার কোন টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নেই। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদির নেকী নিয়ে হাযির হবে। কিন্তু দেখা যাবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারু মাল আত্মসাৎ করেছে, কারু রক্ত প্রবাহিত করেছে ও কাউকে মেরেছে। তখন তার নেকীসমূহ থেকে তাদের বদলা দেওয়া হবে। এভাবে দিতে দিতে তার সব নেকী শেষ হয়ে গেলে বাকী বদলার জন্য দাবীদারদের পাপসমূহ তার উপরে চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (এভাবেই নেকীর পাহাড় নিয়ে আসা লোকটি অবশেষে নেকীহীন নিঃস্ব ব্যক্তিতে পরিণত হবে এবং জাহান্নামে পতিত হবে) (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১২৭ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫ ‘যুলুম অনুচ্ছেদ-২১)
এক্ষণে খাদ্যে বিষ ও ঔষধে ভেজাল মিশানো ও তাতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ও মৃত্যু হওয়া সাধারণভাবে তা‘যীরের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে তা ক্বিছাছ-এর পর্যায়ে চলে যায়। অমনিভাবে ভেজাল সিমেন্টে বিল্ডিং বা ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ করে তা ভেঙ্গে পড়ে যদি মানুষের মৃত্যু হয়, তাহ’লে সেটাও অনেক সময় ক্বিছাছ-এর পর্যায়ে চলে যায়। এইসব নীরব ঘাতকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর আইন তৈরী করা উচিত এবং বিচারকদের নিরপেক্ষভাবে ও নিরাসক্ত মনে এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করা উচিত। কেননা ভেজাল দানকারীরা মানুষ হত্যাকারী এবং তারা নিঃসন্দেহে বান্দার হক বিনষ্টকারী।
কৃপণ ব্যক্তি ও লোভী ধনিক শ্রেণী সাধারণতঃ এই অপকর্মগুলি করে থাকে আরো অধিক ধনী হওয়ার আশায়। বিশেষ করে রমজান মাস এলে এদের শয়তানী নেশা আরো বেড়ে যায়। ফলে ্রমজানের বরকত হাছিলের জন্য যেখানে জিনিষ-পত্রের মূল্য কমানো উচিত এবং লাভ কম করা উচিত, সেখানে এরা লাগামহীন ভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। তারা কেউ কেউ নিয়মিত ছালাত-ছিয়াম ও হজ্জ-ওমরাহ সম্পাদন করে। তাদের ধারণায় এসবের মাধ্যমে বান্দার হক নষ্ট করার মহাপাপ সব মাফ হয়ে যাবে। অথচ তারা জানেন না যে, বান্দার হক বান্দা মাফ না করলে তা কখনো আল্লাহ মাফ করেন না।